
ভোলা জেলার উপকূলীয় দ্বীপ উপজেলা মনপুরা। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূল রক্ষার প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে পরিচিত এখানকার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল। কিন্তু সেই সংরক্ষিত বনই আজ বন বিভাগের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে চরম হুমকির মুখে পড়েছে। অনুসন্ধানে উঠে এসেছে—বন উজাড়, কাঠ পাচার, চাঁদাবাজি, বনভূমি দখল ও সুফল প্রকল্পের নামে অর্থ আত্মসাৎ সহ ভয়ানক আরো অনেক অপরাধের চিত্র। কিছু অসাধু বন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদেই এসব অনিয়ম আর লুটপাট সংঘটিত হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও বনঘেঁষা এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মনপুরার উপকূলীয় সংরক্ষিত বনাঞ্চল থেকে নিয়মিতভাবে কেওড়া, গরান ও বাইন গাছ কাটা হচ্ছে। রাতের আঁধারে নৌকা ও ট্রলারে করে এসব কাঠ বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়। বন আইন, ১৯২৭ (সংশোধিত) অনুযায়ী সংরক্ষিত বন থেকে অনুমতি ছাড়া গাছ কাটা দণ্ডনীয় অপরাধ। আইনে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের বিধান থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বলেই চলে।
একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দৈনিক অপরাধের শিরোনামকে বলেন, “বন কাটার দৃশ্য এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। যাদের দেখভালের কথা, তাদের তৎপরতা দেখা যায় না।”
অনুসন্ধানে জানা যায়, বনাঞ্চলের ভেতরের খাল ও দুর্গম চরগুলো কাঠ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী এসব এলাকায় বন বিভাগের নিয়মিত টহল থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে তা চোখে পড়ার মতো না। পরিবেশ সংশ্লিষ্টদের মতে, এটি দায়িত্বে অবহেলাই নয়, বরং প্রশাসনিক ব্যর্থতা আর যোগসাজশেরই প্রতিফলন।
জেলে ও স্থানীয়দের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ:— বন বিভাগের আওতাধীন এলাকায় মাছ ধরা, নৌযান চলাচল ও গবাদিপশু চরানোর ক্ষেত্রে নিয়মিত ঘুষ ও চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। একাধীক জেলে বলেন, “টাকা না দিলে নৌকা আটক বা মামলা দেওয়ার ভয় দেখানো হয়। বাধ্য হয়েই দিতে হয়।” কিন্তু দণ্ডবিধি অনুযায়ী সরকারি কর্মচারীর ঘুষ গ্রহণ ও ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় ফৌজদারি অপরাধের শামিল।
সামাজিক বনায়নের নামে অনিয়ম:
মনপুরায় বাস্তবায়নাধীন সামাজিক বনায়ন প্রকল্পেও অনিয়মের বাস্তব চিত্র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। স্থানীয়দের দাবি— প্রকৃত উপকারভোগীদের বাদ দিয়ে প্রভাবশালীদের নাম তালিকাভুক্ত করে গাছ না লাগিয়েই কাগজে-কলমে বিল উত্তোলন করা হয়েছে। যা দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও দণ্ডবিধির প্রতারণা ধারার আওতাভুক্ত।
টেন্ডার বাণিজ্য:
মনপুরা উপকূলীয় সংরক্ষিত বনাঞ্চলে শুধু বন উজাড় ও কাঠ পাচার নয়ই—টেন্ডার বাণিজ্য নিয়েও নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে—কোন প্রকল্প, কোন ঠিকাদার পাবেন, তা আগেই ঠিক করা থাকে। প্রকৃত দরপত্র প্রক্রিয়া বাদ দিয়ে শুধুমাত্র প্রভাবশালী ও পছন্দের ঠিকাদারকে টেন্ডার দেওয়া হয়। সরকারি অর্থ নিজেদের পকেটে নিতে পছন্দের ঠিকাদারকে টেন্ডার দেওয়া হয়। বিনিময়ে মোটা অংকের অর্থ লেনদেন হয়। অন্যদিকে ঠিকাদারকে তা পুষিয়ে নিতে অতিরিক্ত কাঠ দেওয়া হয়।
বনভূমি দখল, প্রশাসনের নীরবতা:
উপকূলীয় সংরক্ষিত বনভূমির একাধিক স্থানে অবৈধ বসতি ও নানা ধরনের স্থাপনা গড়ে উঠলেও বন বিভাগের কার্যকর কোনো উচ্ছেদ অভিযান চোখে পড়েনি। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নীরব ভূমিকা পালন করা ও চাঁদা নেওয়ার।
সুফল প্রকল্পে হরিলুট:
সুফল প্রকল্পের আওতায় মনপুরায় সামাজিক বনায়ন, নার্সারি স্থাপন, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী জোরদার, বিকল্প জীবিকায়ন ও উপকারভোগীদের প্রশিক্ষণের কথা থাকলেও বাস্তবে দেখা গেছে—অস্তিত্বহীন বনায়নের বিল উত্তোলন, নিম্নমানের চারা রোপণ দেখিয়ে কোটি টাকা ব্যয় দেখানো, উপকারভোগীর তালিকায় স্বজন ও প্রভাবশালীদের অন্তর্ভুক্তি আর প্রশিক্ষণ ও সভা না করেই কাগজে উপস্থিতি দেখানোর। স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রকল্পের নামে একাধিকবার একই জায়গায় কাজ দেখিয়ে অর্থ তোলা হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ের ভয়াবহ চিত্র:
মনপুরার চরকাচিয়া ও দক্ষিণ সাকুচিয়া এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়—যেখানে প্রকল্প অনুযায়ী সবুজ বেষ্টনী থাকার কথা, সেখানে খালি বালুচর। কোথাও কোথাও লাগানো চারাগাছ শুকিয়ে মরে গেছে, আবার অনেক জায়গায় আদৌ কোনো রোপণের চিহ্ন নেই।
একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা জানান, “আমাদের নাম তালিকায় আছে, কিন্তু কোনো গাছ পাইনি। কেউ কিছু জানতে চাইলে বন বিভাগের লোকজন ভয় দেখায়।”
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ:
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, মনপুরায় সুফল প্রকল্পের আওতায় প্রতি অর্থবছরে কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও তার সিংহভাগই প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা ও ঠিকাদারের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে ভুয়া ভাউচার, মিথ্যা এমবিআর ও জাল স্বাক্ষর ব্যবহার করার মতো অভিযোগও উঠেছে।
বন বিভাগের এসব অপরাধ আড়াল করতে স্থানীয় কয়েকজন সংবাদকর্মীকে মাসিক মাসোয়ারা দেওয়ার তথ্যও উঠে এসেছে দৈনিক অপরাধের শিরোনামের অনুসন্ধানে। অন্যদিকে বন বিভাগের নানা অনিয়ম নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত নিউজকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এসব সাংবাদিকদেরকে হাতিয়ে হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনপুরা রেঞ্জ কর্মকর্তা রাশেদুল হাসান বলেন, সুফল প্রকল্পের কাজ কিছু হয়েছে, আর অন্য বিষয়গুলো জেলা থেকে জানতে পারবেন, আমরা সবাই জেলার আওতাধীন।
পরিবেশবিদদের মতে, মনপুরার মতো উপকূলীয় এলাকায় বন উজাড় অব্যাহত থাকলে— এক দিকে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতি বাড়বে, অন্যদিকে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। ফলে উপকূল রক্ষার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে।
স্থানীয় সচেতন মহল ও পরিবেশকর্মীদের দাবি—
উচ্চপর্যায়ের স্বাধীন তদন্ত গঠন করে জড়িত বন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, অবৈধ দখল উচ্ছেদ, সামাজিক বনায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যান্ত জরুরী। মনপুরার উপকূলীয় বন রক্ষা করা না গেলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো অঞ্চলের পরিবেশ ও জনজীবনের ওপর—এমন আশঙ্কাই এখন সবার।